Sunday, April 23, 2017

আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়


আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চা বিগত শতাব্দীর নববইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরবী বিভাগ এবং কওমী মাদরাসার পাঠ্যসূচীর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র ও পরিধি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে এবং এর জন্য পৃথক পাঠ্যসূচী, প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ ব্যক্তি পর্যায়ে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গড়ে উঠে। এর জন্য এক বছর বা দুবছর মেয়াদি কোর্সও চালু করা হয়। এসব কোর্সে সাধারণত কওমী মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তকারী ও সনদপ্রাপ্ত ছাত্ররা ভর্তি হয় এবং নতুন করে আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় আত্ননিয়োগ করে। এর ফলে তারা আরবী ভাষার ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় এবং বলার ও লেখার যোগ্যতাও কমবেশী লাভ করতে সক্ষম হয়।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি আরবী ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্যের পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করার পরও ছাত্ররা কেন নতুন করে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের কোর্সে ভর্তি হয় এবং কমপক্ষে এক-দুই বছর ব্যয় করে? এর সহজ উত্তর হল, আমাদের কওমী মাদরাসাগুলোর আরবী পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত লক্ষ্য আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পান্ডিত্য অর্জন নয় বরং এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে:
১. বিশুদ্ধভাবে আরবী ইবারত পাঠ করার দক্ষতা অর্জন।
২.আরবী ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদি পাঠ করে এর মর্ম উপলব্ধি করার দক্ষতা অর্জন।
৩.পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অসাধারণ ভাষাগত নৈপুণ্যের সাথে পরিচিতি লাভ।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, কওমী মাদরাসার আরবী পাঠ্যক্রমেও এমন মৌলিক উপাদান রয়েছে যার মাধ্যমে একজন প্রতিভাধর শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হতে পারে। বাসত্মবেও এর প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়।[1]
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত। সেটা হচ্ছে, ভাষা চর্চা ও সাহিত্য চর্চা কি একই বিষয়? নিরেট সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে কি ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষিক দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব? এর পরিষ্কার ও যথার্থ উত্তর হল, না। কারণ, যে কোনো ভাষার প্রাচীন সাহিত্যধর্মী গদ্য ও পদ্যের ভাষা হচ্ছে দুর্বোধ্য, দৈনন্দিন জীবনে অব্যবহৃত এবং ব্যবহারিক জীবনের ভাষিক প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। এই বাস্তবতা কেবল আরবী ভাষার ক্ষেত্রেই নয় পৃথিবীর জীবন্ত যে কোনো ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও লক্ষ্যণীয়। তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আরবী সাহিত্যের প্রাচীন পদ্য আস সাবউল মুআল্লাকাতদিওয়ানুল হামাসাদিওয়ানুল মুতানাববী এবং প্রাচীন গদ্য বিশেষ করে মাকামাতে হারিরী ইত্যাদি প্রামাণ্য ও উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-গ্রন্থাদি পাঠ করে দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক ভাষা শিক্ষা করা আদৌ সম্ভবপর নয়। আর এ কারণেই ছাত্ররা এসব গ্রন্থাদি পাঠ করেও ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য নতুন করে ভাষাচর্চা করতে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ও আরবী সাহিত্যের ছাত্ররা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেও ঐ একই কারণে নতুন করে ভাষা কোর্সে ভর্তি হতে বাধ্য হয়।
     আদব বা সাহিত্য শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার এবং অনেকটা অপপ্রয়োগের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। বিষয়টি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, নিছক নাহু-সরফের স্বল্প মেয়াদি কোর্সের নামও দেয়া হয় ‘‘আরবী আদবের কোর্স’’। আবার কোথাও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মানের আরবী গদ্য ও পদ্যের কোর্সকেও ‘‘আরবী সাহিত্যের কোর্স’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এটাকে ‘‘যুল্ম’’ বললে অযৌক্তিক হবে না। কারণ যুল্ম শব্দের অর্থই হচ্ছে وضع شيء في غير محلهغير محله (কোনো কিছুর অপপ্রয়োগ)। আরও লক্ষ্যণীয় যে, এই স্বল্প মেয়াদি ভাষা কোর্সের নাম দেয়া হয় (تخصص تخصص في الأدب) অর্থাৎ সাহিত্যের অনার্স কোর্স। অথচ অনার্স কোর্স বা বিশেষায়িত কোর্সের জন্য অন্ততপক্ষে চার বছরের প্রয়োজন। অপরদিকে যারা এই কোর্সে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের  অনেকেরই নামের আগে  الأديب الأريب"" (সুসাহিত্যিক) শব্দটি যোগ করা হয়। কাজেই আদব শব্দটির পারিভাষিক অর্থ ও এর মূল উপাদান কী সে ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের অবস্থান যথার্থরূপে ও বাস্তবতার ভিত্তিতে নিরূপণ করতে সক্ষম হব।
বলা বাহুল্য যে, আরবীতে আদব শব্দের একাধিক সংজ্ঞা রয়েছে। এখানে আমরা কেবল তিনটি সংজ্ঞা তুলে ধরতে চাই। এর দুটো হল সাধারণ সংজ্ঞা, আর অপরটি হল ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি কেন্দ্রিক সংজ্ঞা। আদবের দুটো সাধারণ সংজ্ঞ নিম্নরূপ:
 الأدب هو الكلام الإنشائي البليغ الذي يقصد به إلى التأثير في عواطف القراء والسامعين سواء أكان شعرا أم نثرا (د. شوقي ضيف/ تاريخ الأدب العربي)
অর্থ : সাহিত্য হচ্ছে বিরচিত প্রাঞ্জল বক্তব্য -সেটা কাব্য হোক অথবা গদ্য- যার লক্ষ্য হচ্ছে পাঠক ও শ্রোতাবৃন্দের আবেগকে প্রভাবিত করা।
الأدب إنما هو ألفاظ مختارة وتراكيب متقنة وأساليب مجودة, معان مؤثرة. (د. عبد العزيز بن محمد الفيصل / الأدب العربي وتاريخه)
অর্থ: সুচয়িত শব্দাবলী, বলিষ্ঠ গঠনরীতি, সুষমামন্ডিত রচনাশৈলী এবং হৃদয়গ্রাহী অর্থমালাই হচ্ছে সাহিত্য।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি কেন্দ্রিক আদব বা সাহিত্যের সংজ্ঞা হচ্ছে নিমণরূপ:
كل شعر أو نثر يؤثر في النفس، ويهذب الخلق، ويدعو إلى الفضيلة، ويبعد عن الرذيلة بأسلوب جميل (د. عبد العزيز بن محمد الفيصل / الأدب العربي وتاريخه)
অর্থ: সাহিত্য হচ্ছে এমন প্রতিটি কাব্য বা গদ্য যা নান্দনিক প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টি করে, চরিত্রকে পরিশীলিত করে, শালীনতার প্রতি আহবান করে এবং অশালীনতা হতে দূরে রাখে।
উপরোক্ত সংজ্ঞা দ্বারা বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সাহিত্য কেবল ব্যাকরণের কিছু নিয়ম কানুন ও হাজার খানেক শব্দ মুখস্থ করার নাম নয় এবং দুর্লভ বর্ণনাভঙ্গি ও কিছু দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে দুএকটা রচনা লেখাও সাহিত্য চর্চা নয়। সাথে সাথে এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, লেখক মাত্রই সাহিত্যিক নয়। বরং সাহিত্যিক হতে হলে আরও অনেক ভাষিক গুণ ও প্রতিভার অধিকারী হতে হয়। যে কোনো ভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলো অপরিহার্য তা হচ্ছে:
১. শব্দমালা (المفردات)
২. ব্যাকরণ (النحو والصرف)
৩. শব্দতত্ত্ব (علم المعاني)
৪. বর্ণনা বিদ্যা (علم البيان)   
৫. শব্দালঙ্কার (علم البديع)
৬. ছন্দশাস্ত্র (علم العروض)
৭. কল্পনা (الخيال)
৮. আবেগ (العاطفة)
এই বাস্তবতার আলোকে বলা যায় যে, আমাদের দেশে স্বল্প মেয়াদি যে কোর্সগুলোর আয়োজন করা হয়, তা আদৌ সাহিত্যে (متخصص) বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোর্স নয়। বরং তা হচ্ছে প্রাথমিক ভাষা শিক্ষার কোর্স। এই কোর্সের মাধ্যমে ছাত্ররা আরবী ভাষায় বলা, লেখা ও পড়ার যোগ্যতা অর্জনের একটা কার্যকর সুযোগ পায়। এই মৌলিক ভাষিক যোগ্যতা বিশেষ করে পড়া ও বলার যোগ্যতা যথাযথ ও কাঙ্ক্ষিত মানে অর্জন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগে যত্নবান হতে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে:
১. উচ্চারণের বিশুদ্ধতা (صحة النطق)
২. শব্দ কাঠামোর বিশুদ্ধতা (صحة الضبط)
৩. এরাবের বিশুদ্ধতা (صحة الإعراب)
৪. বাচনভঙ্গির বিশুদ্ধতা (صحة الأداء)
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও যথার্থ বাচনভঙ্গি পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় বলা ও পড়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত। তবে সাধারণ লিখিত আরবী ভাষায় যেহেতু স্বরচিহ্ন বা ধ্বনিচিহ্ন (حركات) থাকে না, সাথে সাথে আরবী ভাষায় এমন অনেক শব্দ আছে যার একাধিক কাঠামো থাকলেও তা একক বানানে লেখা হয় তাই সেগুলো পড়ার সময় বাক্যের পূর্বাপর ও প্রসঙ্গ অনুযায়ী সঠিক কাঠামো নির্ণয় করে তা উচ্চারণ করতে হয়। এ জন্য আরবী শব্দের একাধিক কাঠামো ও কাঠামোভেদে অর্থের পার্থক্যটা বিশেষভাবে জানতে হয়। এর জন্য শিক্ষার্থীদেরকে পরিশ্রম করতে হয় এবং ব্যাপক অনুশীলন করতে হয়। তাই কোনো ছাত্র যদি স্বরচিহ্ন বিহীন কোনো আরবী লেখা বিশুদ্ধ উচ্চারণ, বিশুদ্ধ এরাব ও সঠিক শব্দ কাঠামো রক্ষা করে পড়তে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় সে আরবী ভাষা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে। কাজেই এ বিষয়ে শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদেরকেও সজাগ থাকতে হবে এবং তাঁদের মাঝেও এ গুণ পরিপূর্ণরূপে না হলেও যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত পর্যায়ের হতে হবে।
আরবী শিক্ষার্থীকে লিখন যোগ্যতা অর্জনের জন্য অবশ্যই আরবী ভাষায় তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করতে হবে। বানানের নিয়ম-কানূন শিখতে হবে। ব্যাকরণসম্মত ও অর্থপূর্ণ বাক্যগঠন পদ্ধতি জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী একক বিষয়ভিত্তিক পরস্পর যুক্ত ও সুবিন্যস্ত বাক্য গঠনের অনুশীলন করতে হবে। প্রাথমিক সত্মরে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ও সরল বাক্য গঠনের অনুশীলন করানো হবে। পর্যায়ক্রমে তাদের মাঝে বিষয়ভিত্তিক ও বিভিন্ন আকার আকৃতির সরল, যৌগিক ও জটিল বাক্য গঠনের যোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে। সাথে সাথে একই বক্তব্য শব্দ পরিবর্তন এবং বাক্য কাঠামো ও বর্ণনাভঙ্গি পরিবর্তন করে ব্যক্ত করার অনুশীলনও করতে হবে। এ লক্ষ্যে ভাষা শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই বিভিন্ন বর্ণনাভঙ্গির (أساليب البيان) সাথে পরিচিত হতে হবে এবং কোন্ বিষয় বা বক্তব্যের জন্য কোন্ বর্ণনাভঙ্গি উপযোগী সেটাও ভালো জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী বর্ণনাভঙ্গিতে পরিবর্তন ও বৈচিত্র আনতে হবে। তা না হলে তারা একই ধরনের বাক্য গঠনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং একই ধরনের বর্ণনাভঙ্গির মাঝে সীমাবদ্ধ
হয়ে পড়বে। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র কেবল সাহিত্যধর্মী রচনা পড়ে এবং তা অনুকরণ করতে শিখে। তাদের সব বিষয়ের রচনায়ই এই সাহিত্যধর্মী বর্ণনাভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। এমনকি নিরেট গবেষণাধর্মী ও সাধারণ বিষয়ের লেখাতেও তারা ঐ একই সাহিত্যধর্মী বর্ণনাভঙ্গি ব্যবহার করে থাকে, যা অত্যন্ত দোষণীয়। কারণ আরবী প্রবাদবাক্যে সুস্পষ্টরূপে বলা হয়েছে, "لكل مقام مقال" অর্থাৎ অবস্থা ভেদে বক্তব্য হতে হবে। যেমন বিষয় হবে বর্ণনাভঙ্গিও তেমনি হতে হবে। অন্যথায় তা দোষণীয় বলে বিবেচিত হবে।
সমসাময়িক বিষয় ও ব্যবহারিক জীবনের উপযোগী আরবী ভাষা শিখতে হলে অবশ্যই আরবী পত্র-পত্রিকা পড়তে হবে এবং সেখান থেকে শব্দ শিখতে হবে। কারণ পত্রিকা হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যা জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় শব্দ ও পরিভাষা উপস্থাপন করে থাকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদ ও প্রবন্ধাদি প্রকাশ করার মাধ্যমে। যে কোনো জীবন্ত ও বহুল ব্যবহৃত ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা ভাষাবিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেন এবং ব্যবহারিক জীবনের উপযোগী যে কোনো ভাষা শিক্ষার জন্য ঐ ভাষার পত্র-পত্রিকা পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই আধুনিক ও ব্যবহারিক আরবী ভাষা শিখতেও এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। একটা কথা আমাদের ভালো করেই মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব আরবী গ্রন্থ সমসাময়িক যুগের লেখকগণ রচনা করেছেন সেগুলো পড়ে বুঝার জন্যও আমাদেরকে এই আধুনিক ও ব্যবহারিক আরবী ভাষা শিখতে হবে। কাজেই আমাদের দেশে আরবী ভাষা শিক্ষা কোর্সে আরবী সংবাদপত্র পঠন ও অনুধাবনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এর জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ব্যবস্থাও করতে হবে।
পরিশেষে যে বিষয়টির প্রতি আরবী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হল, ভাষিক যোগ্যতা অর্জনের জন্য আমাদের ভাষা চর্চাটা হতে হবে সামগ্রিক এবং তা অবশ্যই ব্যবহারিক, তাত্ত্বিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং প্রয়োজন পূরণে হতে হবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ। আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ভাষা চর্চার পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও নিয়মতান্ত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক সাধনা ও অনুশীলন। অন্যথায় আমাদের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত মানের আরবী ভাষা শিক্ষাও সম্ভব হবে না এবং আরবী সাহিত্য চর্চাও সম্ভব হবে না।
::
লিখেছেনঃ মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী

Monday, April 17, 2017

কুরআন তিলাওয়াত করার নিয়ত

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার জন্য কোনো নিয়তের প্রয়োজন হয় না, যেভাবে তিলাওয়াত করা হোক ইবাদাত হিসেবে সংগঠিত হয়; যদি তিলাওয়াতের পশ্চাতে রিয়া তথা প্রদর্শনেচ্ছা ও উজব বা অহংকার না থাকে। রিয়া কখনো আমলের সাওয়াব বিনষ্ট করে, কখনো সাওয়াবের পথে প্রতিবন্ধক হয়, ফলে আদতে কোনো সাওয়াব হয় না।

গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদাত আঞ্জাম দেওয়া, অথবা আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ উভয়ের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত সম্পাদন করাকে রিয়া বলা হয়। রিয়া যুক্ত আমলে কখনো শুধু গায়রুল্লাহ উদ্দেশ্য হয়, কখনো আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ উভয় উদ্দেশ্য হয়। এ জন্য রিয়ার অপর নাম হচ্ছে ‘আশ-শির্কুল খাফি’ বা গোপন শির্ক।

রিয়া কোনো ব্যক্তির আমল ও শ্রম উভয় বিনষ্ট করে এবং ব্যক্তিকে আল্লাহর গোস্বা ও শাস্তিতে নিক্ষেপ করে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَه»

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন, শরীকদের মাঝে আমি অংশীদারিত্ব থেকে সবচেয়ে বেশী অমুখাপেক্ষী, যে এমন আমল করল, যাতে আমার সাথে অপরকে শরীক করেছে, আমি তাকে ও তার শির্ককে ত্যাগ করি”।[1] রিয়াকারী ও তার আমল আল্লাহর নিকট পরিত্যক্ত ও প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ তা‘আলা শুধু তাই গ্রহণ করেন, যা একমাত্র তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা হয়। তিনি ইরশাদ করেন:

﴿قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰٓ إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠﴾ [الكهف:١١٠]

“বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে”।[2] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيحِ الدّجّالِ؟» قَالوا: بَلَىَ. فَقَالَ: «الشّرْكُ الْخَفِيّ: يَقُومَ الرّجُلُ يُصَلّي فَيُزَيّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ إليه»

“আমি কি তোমাদেরকে সেটা সম্পর্কে সংবাদ দিব, যা আমার দৃষ্টিতে তোমাদের উপর মাসীহ-দাজ্জাল থেকেও বিপদজনক? তারা বলল: অবশ্যই, তিনি বললেন: ‘আশ-শির্কুল খাফি’, ব্যক্তি সালাত আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়, অতঃপর সে সালাতকে খুব সুন্দর করে আদায় করে, কারণ সে জানে মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে”।[3] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ سَمَّعَ، سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي، يُرَائِي اللَّهُ بِهِ »

“যে শোনাতে চায়, আল্লাহ তা শুনিয়ে দেন এবং যে দেখাতে চায় আল্লাহ তা দেখিয়ে দেন”। খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এ হাদিসের অর্থ হচ্ছে, যে ইখলাস বিহীন আমল করল, অর্থাৎ মানুষ দেখবে ও শুনবে এ উদ্দেশ্যে আমল করল, তাকে অনুরূপ প্রতিদান দেওয়া হয়। উদাহরণত আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন, তাকে লাঞ্ছিত করেন ও তার অন্তরের গোপন নিয়ত সবাইকে জানিয়ে দেন”।[4]

অপর সহি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ لِيُعَرِّفَهُ نِعَمَهُ، فَعَرَفَهَا، فَقَالَ: مَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَال: تَعَلَّمْتُ فِيكَ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ، وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، فَقَال: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ لِيُقَالَ: هُوَ عَالِمٌ، فَقَدْ قِيلَ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أَمَرَ بِهِ، فَيُسْحَبُ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ»

“… এবং ঐ ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, যে ইলম শিখেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ স্পষ্ট করার জন্য তাকে উপস্থিত করা হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি বলবেন: তার (নিয়ামতের) বিনিময়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে: আপনার জন্য ইলম শিখেছি, শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। তিনি বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ; তুমি ইলম শিখেছি যেন বলা হয় সে আলেম, আর তা বলা হয়েছে। তুমি কুরআন তিলাওয়াত করেছ, যেন বলা হয় সে কারি, আর তা বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে নির্দেশ জারি করবেন, ফলে তাকে চেহারার উপর টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে”।[5]

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃত তিলাওয়াত ইবাদত, হোক সালাতের ভিতরে কিংবা বাইরে, তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়তের প্রয়োজন নেই।তবে কেউ যদি নির্দিষ্ট নিয়তে কুরআন তিলাওয়াত করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই, বরং ভালো। কারণ, নির্দিষ্ট নিয়ত কুরআনুল কারিমে চিন্তা করা, তার রঙে রঙিন হওয়া ও তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার শামিল, যার নির্দেশ শরীয়তে রয়েছে।এ জাতীয় নিয়ত প্রশংসনীয়। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ، فَقُلْتُ يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ، ثُمَّ مَضَى، فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ، فَمَضَى، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ بِهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ النِّسَاءَ فَقَرَأَهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ فَقَرَأَهَا، يَقْرَأُ مُتَرَسِّلًا، إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيهَا، تَسْبِيحٌ سَبَّحَ، وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ»

“আমি কোনো একরাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করি, তিনি সূরা বাকারা আরম্ভ করেন। আমি মনে করলাম একশত আয়াত শেষে রুকু করবেন, কিন্তু তিনি পড়তে থাকলেন; আমি মনে করলাম এক সালাতে তা পূর্ণ করবেন, কিন্তু তিনি পড়তে থাকলেন, আমি মনে করলাম তার দ্বারা এক রাকাত পূর্ণ করবেন; অতঃপর তিনি সূরা নিসা আরম্ভ করেন এবং তা শেষ করেন। অতঃপর আলে-ইমরান শুরু করেন এবং তা শেষ করেন। তিনি বিরতি দিয়ে-দিয়ে পড়ছিলেন, যখন তাসবীহ এর কোনো আয়াত পড়তেন তাসবীহ পাঠ করতেন; যখন প্রার্থনার কোনো আয়াত পড়তেন প্রার্থনা করতেন; যখন আশ্রয় চাওয়ার কোনো আয়াত পড়তেন আশ্রয় চাইতেন”।[6]

ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘আউফ ইবন মালিক আশজা‘য়ি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

«قُمْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً ” فَقَامَ فَقَرَأَ سُورَةَ الْبَقَرَةِ لَا يَمُرُّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ إِلَّا وَقَفَ فَسَأَلَ، وَلَا يَمُرُّ بِآيَةِ عَذَابٍ إِلَّا وَقَفَ فَتَعَوَّذَ»

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একরাত কিয়াম করেছি, তিনি দাঁড়ালেন এবং সূরা বাকারা শেষ করলেন। তিনি রহমতের এমন কোনো আয়াত পড়েননি যেখানে বিরতি নেননি, আর আযাবের এমন কোনো আয়াত তেলাওয়াত করেন নি যেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেননি”।[7]

এসব হাদিস প্রমাণ করে, তিলাওয়াতের সময় কুরআনুল কারিমের অর্থ ও বিষয়-বস্তুতে চিন্তা করা, তার রঙে রঙিন হওয়া, দোয়ার আয়াতে দোয়া করা ও শাস্তির আয়াতে প্রার্থনা করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।এ সুন্নতের উপর আমল করার জন্য নির্দিষ্ট নিয়তে তিলাওয়াত করা অধিকতর সাওয়াবের কাজ।

বর্তমান যুগে মুসলিমরা সাওয়াবের নিয়ত ব্যতীত কোনো উদ্দেশ্যে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করে না বললেই চলে, তাই তিলাওয়াতের সময় কুরআনুল কারিমের ইলম ও জ্ঞানের দিকে তাদের মন ধাবিত হয় না। অথচ ইলম, হিদায়াত ও রহমত লাভের নিয়তে তিলাওয়াত করে সাওয়াবসহ অনেক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»

“নিশ্চয় প্রত্যেক আমল নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত, আর প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে-যা সে নিয়ত করেছে”।[8]

কিয়ামতের দিন নিয়তের কারণে আমলের সাওয়াবে অনেক ব্যবধান হবে। এ জন্য নিয়তকে জ্ঞানীদের ব্যবসা বলা হয়। নিম্নে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার কয়েকটি নিয়ত উল্লেখ করছি:

১. কুরআনুল কারিম ইলমের ভাণ্ডার ও হিদায়াতের উৎস, তাই ইলম ও হিদায়াত লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা।আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء : ٨٢]

“তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত”।[9] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীস্বরূপ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”।[10]

২. মানব জাতির জীবন বিধান স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারিম নাযিল করেছেন, তাই তিলাওয়াত করার সময় তার উপর আমল করার নিয়ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ ٣ ﴾ [الاعراف: ٣]

“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না”।[11] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ يَهۡدِيهِمۡ رَبُّهُم بِإِيمَٰنِهِمۡۖ ٩﴾ [يونس: ٩]

“নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে, তাদের রব ঈমানের কারণে তাদেরকে পথ দেখাবেন”।[12]

৩. কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করার ফলে ঈমান বৃদ্ধি হয়, তাই ঈমান বৃদ্ধির নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَزَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَهُمۡ يَسۡتَبۡشِرُونَ ١٢٤التوبة:124].

“আর যখনই কোন সূরা নাযিল করা হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটি তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অতএব যারা মুমিন, নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়”।[13]

৪. কুরআনুল কারিম আল্লাহর কালাম, যে কুরআন তিলাওয়াত করে সে আল্লাহর সাথে কথা বলে, আল্লাহ তার কথা খুব শ্রবণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ، مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ »

“আল্লাহ কোনো বস্তু এভাবে শ্রবণ করেননি, যেভাবে কুরআনের ক্ষেত্রে সুন্দর আওয়াজ সম্পন্ন নবীর জন্য শ্রবণ করেছেন, যিনি উচ্চস্বরে কুরআন মাজিদ পড়েন।”[14]

৫. কুরআন শিফা ও রোগ থেকে মুক্তির উপায়। কুরআন তিলাওয়াতের ফলে শরীর ও আত্মার রোগ দূরীভূত হয়। অতএব রোগ থেকে মুক্তি ও ঝাড়-ফুকের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس : ٥٧]

“হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত”।[15]

কিয়ামতের দিন উঁচু মর্যাদা লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ ٩٠ ﴾ [الانبياء: ٩٠]

“নিশ্চয় তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর আমাকে আশা ও ভীতিসহ ডাকত, আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী”।[16]

সাওয়াব ও মহান প্রতিদান লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। উকবাহ ইবনে ‘আমের আল-জুহানি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ فِي الصُّفَّةِ، فَقَالَ: أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ، أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ فَيَأْتِيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ، فِي غَيْرِ إِثْمٍ، وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ؟ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، نُحِبُّ ذَلِكَ، قَالَ: ” أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ، أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ؟ »

“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে আসলেন, আমরা তখন সুফফায় ছিলাম, তিনি বললেন: তোমাদের থেকে কে পছন্দ করে প্রতিদিন বুতহান অথবা আকিক স্থানে যাবে, অতঃপর সেখান থেকে উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট দু’টি উট নিয়ে আসবে, অপরাধ সংগঠন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ব্যতীত? আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তা পছন্দ করি। তিনি বললেন: তাহলে কেন তোমাদের কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাব থেকে দু’টি আয়াত শিখে না, অথবা তিলাওয়াত করে না, যা তার জন্য দু’টি উট থেকে উত্তম, এবং তিনটি আয়াত তিনটি উট থেকে উত্তম, এবং চারটি আয়াত চারটি উট থেকে উত্তম, অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা উটের সংখ্যা থেকে উত্তম”।[17]

কিয়ামতের দিন কুরআনুল কারিম তার তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে, তাই সুপারিশ লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ، فَإِنَّهُ شَافِعٌ لِصَاحِبِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، تَعَلَّمُوا الزَّهْرَاوَيْنِ: سُورَةَ الْبَقَرَةِ، وَآلِ عِمْرَانَ، فَإِنَّهُمَا يَجِيئَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ غَيَايَتَانِ أَوْ كَفِرْقَيْنِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ، يَشْفَعَانِ لِصَاحِبِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، تَعَلَّمُوا الْبَقَرَةَ، فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ، وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ، وَلا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ »

“তোমরা কুরআন শিখ, কারণ কিয়ামতের দিন কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। তোমরা দু’টি উজ্জ্বল বস্তু শিখ: সূরা বাকারা ও সূরা আলে-ইমরান, কারণ কিয়ামতের দিন এ দু’টি সূরা দু’টি মেঘের মত, অথবা দু’টি ছায়ার মত, অথবা সারিবদ্ধ উড়ন্ত পাখির দু’টি ডানার মত, কিয়ামতের দিন তারা উভয়ে তাদের পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে, তোমরা সূরা বাকারা শিক্ষা কর, কারণ তা শিক্ষা করা বরকত ও ত্যাগ করা অনুশোচনা, কোনো জাদুকর তা শিখতে সক্ষম নয়”।[18]

আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَقُصُّ عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ أَكۡثَرَ ٱلَّذِي هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ٧٦ وَإِنَّهُۥ لَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٧٧[النمل:76-77]

“নিশ্চয় এ কুরআন তাদের কাছে বর্ণনা করছে, বনী ইসরাইল যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছে তার অধিকাংশই; আর নিশ্চয় এটি মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত”।[19]

প্রিয়পাঠক, আল্লাহর রহমত লাভের নিয়তে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন। কখনো চিন্তা করেছি, কি পরিমাণ রহমতের মুখাপেক্ষী আমরা, আমরা কত পাপ করেছি, কত অপরাধ ও অন্যায়ে জড়িত হয়েছি; সমাজে আমরা দুর্বল, দেশে আমরা নিগৃহীত, বিশ্বে আমরা কর্তৃত্বশূন্য, আল্লাহর রহমত ব্যতীত যার থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। সে রহমত আমাদের সামনেই রয়েছে, অথচ তার থেকে আমরা গাফিল। কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা রহমত, তার তিলাওয়াত অপর থেকে শ্রবণ করা রহমত এবং তার উপর আমল করা রহমত। আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَقَدۡ جِئۡنَٰهُم بِكِتَٰبٖ فَصَّلۡنَٰهُ عَلَىٰ عِلۡمٍ هُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٥٢﴾ [الاعراف: ٥١]

“আর আমি তো তাদের নিকট এমন কিতাব নিয়ে এসেছি, যা আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। তা হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ এমন জাতির জন্য, যারা ঈমান রাখে”।[20] অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿هَٰذَا بَصَآئِرُ مِن رَّبِّكُمۡ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٢٠٣ ﴾ [الاعراف: ٢٠٢]

“এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ। আর তা হিদায়াত ও রহমত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে”।[21] অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:

﴿ وَهَٰذَا كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ مُبَارَكٞ فَٱتَّبِعُوهُ وَٱتَّقُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٥٥ ﴾ [الانعام: ١٥٥]

“আর এটি কিতাব- যা আমি নাযিল করছি- বরকতময়। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও”।[22] অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:

﴿ وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤ ﴾ [الاعراف: ٢٠٣]

“আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর”।[23]

লক্ষ্য করুন কুরআনুল কারিম তিলাওয়াতের সময় চুপ করে থাকাও রহমত লাভ করার উপায়। তিলাওয়াতকারীকে আল্লাহর রহমত বেষ্টন করে নেয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ »

“আর আল্লাহর ঘরসমূহ থেকে কোনো ঘরে যখনই কোনো কওম একত্র হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে ও নিজেদের মাঝে তার পঠন-পাঠন করে, তবে অবশ্যই তাদের উপর সাকিনা নাযিল হয়, রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, মালায়েকাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করেন, যারা তার নিকটে আছে তাদের মাঝে”।[24]

হে আল্লাহ, কুরআন দ্বারা আমাদের উপর রহম করুন, যেন অন্য কারো রহমতের প্রয়োজন না হয়। নিশ্চয় আপনার রহমত সর্বোত্তম।

﴿ لَمَغۡفِرَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَحۡمَةٌ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ١٥٧ ﴾ [ال عمران: ١٥٧]

“নিশ্চয় আল্লাহর মাগফেরাত ও রহমত অধিকতর উত্তম, তোমরা যা জমা কর তার চেয়ে”।[25]

– সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

[1]মুসলিম: (২৯৮৮)

[2]সূরা কাহাফ: (১১০)

[3]আহমদ: (১০৮৫৯), ইবনে মাজাহ: (৪২০৪)

[4]ফাতহুল বারিসহ সহি বুখারি, হাদিস নং: (৯৪৭৪)

[5]আহমাদ: (৮২৭৮)

[6] মুসলিম: (৭৭৫)।

[7]আবু দাউদ: (৮৭৩)।

[8]বুখারি: (১)

[9]সূরা নিসা: (৮২)

[10]সূরা বাকারা: (১৮৫)

[11]সূরা আ‘রাফ: (৩)

[12]সূরা ইউনুস: (৯)

[13]সূরা তাওবা: (১২৪)

[14]সহি বুখারি ৭৫৪৪, ৫০২৩, ৫০২৪, ৭৪৮২, ৭৫২৭, মুসলিম ৭৯৪,

[15]সূরা ইউনুস: (৫৭)

[16]সূরা আম্বিয়া: (৯০)

[17]মুসলিম: (৮০৬), আবু দাউদ: (১৪৫৬)

[18]আহমদ: (৮৮২৩)

[19]সূরা নামল: (৭৬-৭৭)

[20]সূরা আ‘রাফ: (৫২)

[21]সূরা আ‘রাফ: (২০৩)

[22]সূরা আন‘আম: (১৫৫)

[23]সূরা আ‘রাফ: (২০৪)

[24]মুসলিম: (২৭০২),
[25]সূরা আলে-ইমরান: (১৫৭)

আল কুরআনের হক

কুরআনুল কারীম বিশ্ব মানবতার জন্য এক অফুরন্ত নিয়ামাত। আল্লাহ তা‘আলার বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢﴾ [الرحمن: ١، ٢]
বড়ই মেহেরবান তিনি (আল্লাহ) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন’ -[সূরা আর-রহমান : ১-২]।
কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই বর্বর জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন।
তিনি বলেছেন,
«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي».
বিশ্বমানবমন্ডলীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো আমার যুগ’ -[সহীহ বুখারী : ২৬৫২]।
কুরআন মাজীদের বেশ কিছু হক রয়েছে যেগুলো আদায় করা আবশ্যক। এর অনেকগুলো হক এমন যে, কেউ যদি তা আদায় না করে কিয়ামাতের দিন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করবেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ مَهۡجُورٗا ٣٠﴾ [الفرقان: ٣٠]
‘আর রাসূল বলবেন (কিয়ামাতে), ‘‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার জাতি এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’’ -[সূরা আল-ফুরকান : ৩০]।
আমাদের উপর কুরআনের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো :
ঈমান আনা
কুরআনের হকসমূহের মধ্যে প্রধানতম হক বা অধিকার হলো কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো : কুরআন আল্লাহর কালাম, ইহা আসমানী শেষ কিতাব এবং এই কিতাবের মধ্য দিয়ে সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গিয়েছে। কুরআন বিশ্ব মানবমন্ডলীর জন্য হিদায়াত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর বা আলো। কুরআনে এসেছে,
﴿فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلۡنَاۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ٨﴾ [التغابن: ٨]
অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে নূর অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ -[সূরা আত-তাগাবুন : ০৮]।
﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [البقرة: ٨٥]
‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্চনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ৮৫]।
সহীহভাবে পড়তে জানা
কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١﴾ [العلق: ١]
‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরাহ আলাক : ১]। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
«تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»
‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তা তিলাওয়াত কর’ [মুসনাদ আল-জামি‘ : ৯৮৯০]।
তিলাওয়াত করা ও শুনা
কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে,
﴿ٱتۡلُ مَآ أُوحِيَ إِلَيۡكَ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ﴾ [العنكبوت: ٤٥]
‘তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর’ -[সূরাহ আনকাবুত : ৪৫]।
সহীহভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষা করতে হবে। বাংলাভাষায় উচ্চারণ করে পড়লে হবে না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : « لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ»
আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কুরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়’ -[সহীহ বুখারী : ৭৫২৭]।
ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে।
﴿وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا ٤﴾ [المزمل: ٤]
‘তুমি কুরআনকে তারতীলের সাথে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াত কর’ -[সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪]।
আর কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا ، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ »
‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’ -[সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০]।
কুরআন তিলাওয়াত শুনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «اقْرَأْ عَلَيَّ الْقُرْآنَ قُلْتُ آقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ قَالَ إِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَسْمَعَهُ مِنْ غَيْرِي»
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও, আমি বললাম, আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, আমি আপনাকে কীভাবে কুরআন শুনাবো? তখন তিনি বললেন, আমি অপরের নিকট থেকে কুরআন শুনতে ভালবাসি’ -[সহীহ বুখারী : ৫০৪৯]।
অপরকে শিক্ষা দেয়া
কুরআনের অন্যতম হক হলো তা অপরকে শিক্ষা দেয়া। আমাদের প্রিয় নবীর অন্যতম কাজ ছিল মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ١٦٤﴾ [آل عمران: ١٦٤]
‘‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল’’-[সূরা আলে ইমরান : ১৬৪]। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হাদীসে এসেছে,
عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ« خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»
উসমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’-[সহীহ বুখারী : ৫০২৭]। যদি কেউ অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়, তবে তাঁর জন্য শিক্ষাগ্রহণকারীর সমান সাওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে,
«الْدَّال عَلَى الْخَيْر كَفَاعِلِه»
‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরুপ সাওয়াব পাবে’’ -[সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]।
হিফয বা মুখস্থ করা
কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ হিফযেরই এক প্রকার হচ্ছে, বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানো। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন। কুরআনে এসেছে,
﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: ٩]
‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ -[সূরা আল-হিজর : ০৯]।
যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا »
‘‘ কুরআনের হাফেযকে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়’’ -[সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]।
বুঝা ও উপলব্ধি করা
কুরআনের অর্থ বুঝা ও অনুধাবন করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য ও দাবী আমরা কেউ পালন করতে পারবো না। না বুঝে পড়লে কুরআনের আসল মজা পাওয়া যাবে না। কুরআন বুঝার জন্য শব্দের অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যা, অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা প্রেক্ষাপট এবং কুরআনের আয়াতসমূহের শিক্ষা জানতে হবে। কুরআনে এসেছে,
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٢﴾ [يوسف: ٢]
‘‘নিশ্চয় আমি একে আরবী কুরআনরূপে নাযিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার’’-[সূরা ইউসুফ: ০২]। কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য না নিলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য নিলেই কেবল সহীহভাবে কুরআন বুঝা সম্ভব। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]
‘‘আর রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও’’-[সূরা আল-হাশর: ৭]। কুরআন বুঝার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤﴾ [محمد : ٢٤]
‘‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না ? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে’’- [সূরা মুহাম্মাদ : ২৪]।
আমল করা
কুরআনের আমল করার অর্থ, কুরআনের অনুসরণ করা। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে,
﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الأعراف: ٣]
‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’ -[সূরা আল-আরাফ : ৩]।
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«كُنَّا نَتَعَلَّمُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ فَمَا نَعْلَمُ الْعَشْرَ الَّتِي بَعْدَهُنَّ حَتَّى نَتَعَلَّمَ مَا أُنْزِلَ فِي هَذِهِ الْعَشْرِ مِنَ الْعَمَلِ»
‘আমরা যখন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’ -[শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০]।
যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া
কুরআন মাজীদ সম্মানিত এবং যারা কুরআনের সাথে থাকবে তাঁরাও সম্মানের অধিকারী। এজন্য কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাঁর হক আদায় করতে হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١﴾ [البقرة: ١٢١]
‘যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তাঁরা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তাঁরাই তাঁর প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, সে-ই ক্ষতিগ্রস্থ’ -[সূরা আল-বাকারাহ : ১২১]। কুরআনকে মহববত করা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করার শামিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«من أحبَّ القرآنَ أحبَّ اللهَ ورسولهَ»
যে কুরআনকে মহববত করল সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মহববত করল’-[জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ৩২৯]।
কুরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা
কুরআনের প্রচার, প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা কুরআনের অন্যতম হক। নিজ ব্যবস্থাপনায় কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা, হিফয প্রতিযোগিতা, কুরআন বুঝার আসর, তাফসীর প্রতিযোগিতা, মাকতাব চালু করা, বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের মুয়াল্লিম প্রেরণ বা মুয়াল্লিম স্পন্সর করা, কুরআন বিতরণ করা, কুরআনের মুয়াল্লিম তৈরি করা, কুরআনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা, এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি কুরআনের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿وَأَنۡ أَتۡلُوَاْ ٱلۡقُرۡءَانَۖ فَمَنِ ٱهۡتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهۡتَدِي لِنَفۡسِهِۦۖ وَمَن ضَلَّ فَقُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ٩٢﴾ [النمل: ٩٢]
আর আমি যেন আল-কুরআন অধ্যয়ন করি, অতঃপর যে হিদায়াত লাভ করল সে নিজের জন্য হিদায়াত লাভ করল; আর যে পথভ্রষ্ঠ হল তাকে বল, আমিতো সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত’ -[সূরা আন-নামল : ৯২]
﴿۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ ﴾ [المائ‍دة: ٦٧]
হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭]। কুরআন তিলাওয়াত, হিফয, প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠার কাজে আনন্দ প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। কুরআন এমন একটি কিতাব যা নিয়ে ঈমানদার বান্দাহগণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। কেননা আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨﴾ [يونس: ٥٧، ٥٨]
‘হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম’ -[সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮]। আবূ সাইদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ হলো আল-কুরআন এবং এর অধিকারী হওয়াই রহমত’ -[শুয়াবুল ঈমান]।
প্রিয় পাঠক!
আমরা কি কুরআনের হকগুলো আদায় করতে পারছি? আদায় করার জন্য কোন প্রচেষ্টা আছে কি? আসুন কুরআনের হকগুলো আদায় করি, কিয়ামাতের সেই ভয়াবহ দিনে কুরআনের সুপারিশ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআনের হকগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!
-হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল
সম্পাদনা : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

Friday, April 14, 2017

কুরআনের কোথায়ও আপনার কথা আছে?

আহনাফ বিন কায়েস নামক একজন আরব সর্দারের কথা বলছি।
তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। তার সাহস ও শৌর্য ছিল অপরিসীম।
তার তলোয়ারে ছিল লক্ষ যোদ্ধার জোর। ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহর নবী (সাঃ) কে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি, তবে নবীর বহু সাথীকে তিনি দেখেছেন।
এদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।
একদিন তার সামনে এক ব্যক্তি কুরআনের এই আয়াতটি পড়লেন- আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি, যাতে 'তোমাদের কথা' আছে, অথচ তোমরা তা চিন্তা ভাবনা করোনা, (সুরা আল আম্বিয়া- ১০)
আহনাফ ছিলেন আরবী সাহিত্যে গভীর পারদর্শী ব্যক্তি। তিনি ভাল করেই বুঝতেন 'যাতে শুধু তোমাদের কথাই আছে ' এই কথার অর্থ কি? তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন কেউ বুঝি তাকে আজ নতুন কিছু শোনালো! মনে মনে বললেন , আমাদের কথা আছে ? কই কোরআন নিয়ে আসো তো? দেখি এতে আমার কথা কি আছে? তার সামনে কোরআনে কারিম আনা হলো, একে একে বিভিন্ন দল উপদলের পরিচিতি পেশ করা হচ্ছে-
একদল লোক এলো, তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়, শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহখাতার জন্য মাগফেরাত কামনা করে। (সুরা আয যারিয়াত- আয়াত ১৭-১৯)
আবার একদল লোক এলো, তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে , তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে । তারা অকাতরে আমার দেয়া রিযিক থেকে খরচ করে। ( সুরা হা- মীম সেজদা- ১৬)
কিছুদুর এগিয়ে যেতেই তার পরিচয় হলো আরেক দল লোকের সাথে। তাদের সম্পর্কে বলা হলো, রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সেজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়। (সুরা আল ফোরকান- ৬৪)
অতঃপর এলো আরেকদল মানুষ, এদের সম্পর্কে বলা হলো, এরা দারিদ্র্য ও সাচ্ছন্দ্য উভয় অবস্থায় (আল্লাহর নামে) অর্থ ব্যয় করে, এরা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, এরা মানুষদের ক্ষমা করে,বস্তুত আল্লাহ তায়ালা এসব নেককার লোকেদের দারুণ ভালোবাসেন। ( সুরা আল ইমরান- ১৩৪)
এলো আরেকটি দল , তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, এরা (বৈষয়িক প্রয়োজনের সময়) অন্যদেরকে নিজেদেরই ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদেরকে কার্পণ্য থেকে দুরে রাখতে পারে তারা বড়ই সফলকাম। (সুরা আল হাশর- ৯)
একে একে এদের সবার কথা ভাবছেন আহনাফ। এবার কোরআন তার সামনে আরেকদল লোকের কথা পেশ করলো, এরা বড়ো বড়ো গুনাহ ও নির্লজ্জ অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয় তখন (প্রতিপক্ষকে ) মাফ করে দেয়, এরা আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলে, এরা নামাজের প্রতিষ্ঠা করে, এরা নিজেদের মধ্যেকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে। (সুরা আশ- শুরা- ৩৭,৩৮)
হযরত আহনাফ নিজেকে নিজে জানতেন। আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত এ লোকদের কথাবার্তা দেখে তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা , আমি তো এই বইয়ের কোথাও আমাকে খুজে পেলাম না। আমার কথা কই? আমার ছবি তো এর কোথাও আমি দেখলাম না , অথচ এ কিতাবে তুমি নাকি সবার কথাই বলেছো।
এবার আহনাফ ভিন্ন পথ ধরে কোরআনে নিজের ছবি খুঁজতে শুরু করলেন। এ পথে ও তার সাথে বিভিন্ন দল উপদলের সাক্ষাত হলো। প্রথমত তিনি পেলেন এমন একটি দল, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন তাদের বলা হয়, অল্লাহ তায়লা ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে এবং বলে , আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের জন্য আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবো? (সুরা আস সাফফাত- ৩৫,৩৬)
তিনি আরো সামনে এগুলেন, দেখলেন আরেকদল লোক। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন এদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদরে সামনে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয় তখন এদের মন আনন্দে নেচে উঠে। (সুরা আয যুমার-৪৫)
তিনি আরো দেখলেন, কতিপয় হতভাগ্য লোককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে, আমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরীব মেসকীনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ- আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম, এভাবেই একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে হাজির হয়ে গেলো। (সুরা আল মোদ্দাসসের, ৪২-৪৬)
হযরত আহনাফ কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের মানুষের বিভিন্ন চেহারা ছবি ও তাদের কথা দেখলেন। বিশেষ করে এই শেষোক্ত লোকদের অবস্থা দেখে মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ , এ ধরনের লোকদের উপর আমি তো ভয়ানক অসন্তষ্ট। আমি এদের ব্যাপারে তোমার আশ্রয় চাই। এ ধরনের লোকদের সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নেই। তিনি নিজেকে নিজে ভালো করেই চিনতেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজেকে এই শেষের লোকদের দলে শামিল বলে ধরে নিতে পারলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণীর লোকদের কাতারেও শামিল করতে পারছেন না। তিনি জানতেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে ঈমানের দৌলত দান করেছেন। তার স্থান যদিও প্রথম দিকের সম্মানিত লোকদের মধ্যে নয় কিন্তু তাই বলে তার স্থান মুসলমানদের বাইরেও তো নয়।
তার মনে নিজের ঈমানের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, তেমনি নিজের গুনাহখাতার স্বীকৃতি ও সমানভাবে মজুদ ছিলো। কোরআনের পাতায় তাই এমন একটি ছবির সন্ধান তিনি করছিলেন, যাকে তিনি একান্ত 'নিজের' বলতে পারেন। তার সাথে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও দয়ার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর আস্থাশীল। তিনি নিজের নেক কাজ গুলোর ব্যাপারে যেমন খুব বেশী অহংকারী ও আশাবাদী ছিলেন না, তেমনিভাবে আল্লাহর রহমত থেকেও তিনি নিরাশ ছিলেন না। কোরআনের পাতায় তিনি এমনি একটি ভাল মন্দ মেশানো মানুষের ছবিই খুঁজছিলেন এবং তার বিশ্বাস ছিলো এমনি একটি মানুষের ছবি অবশ্যই তিনি এই জীবন্ত পুস্তকের কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন।
কেন, তারা কি আল্লাহর বান্দা নয় যারা ঈমানের 'দৌলত' পাওয়া সত্বেও নিজেদের গুনাহর ব্যাপারে থাকে একান্ত অনুতপ্ত। কেন, আল্লাহ তায়ালা কি এদের সত্যিই নিজের অপরিসীম রহমত থেকে মাহরূম রাখবেন? এই কেতাবে যদি সবার কথা থাকতে পারে তাহলে এ ধরনের লোকের কথা থাকবে না কেন? এই কেতাব যেহেতু সবার, তাই এখানে তার ছবি কোথাও থাকবে না- এমন তো হতেই পারে না। তিনি হাল ছাড়লেন না । এই পুস্তকে নিজের ছবি খুঁজতে লাগলেন। আবার তিনি কেতাব খুললেন।
কোরআনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় সত্যিই আহনাফ 'নিজেকে' উদ্ধার করলেন। খুশীতে তার মন ভরে উঠলো। আজ তিনি কোরআনে নিজের ছবি খুঁজে পেয়েছেন, সাথে সাথেই বলে উঠলেন, হ্যাঁ, এইতো আমি !
'হ্যাঁ এমন ধরনের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালো মন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে - কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা বড়ো দয়ালু বড়ো ক্ষমাশীল।' (সুরা আত তাওবা- ১২)
হযরত আহনাফ আল্লাহর কেতাবে নিজের ছবি খুঁজে পেয়ে গেলেন, বললেন, হাঁ, এতোক্ষণ পর আমি আমাকে উদ্ধার করেছি। আমি আমার গুনাহর কথা অকপটে স্বীকার করি, আমি যা কিছু ভালো কাজ করি তাও আমি অস্বীকার করি না। এটা যে আল্লাহর একান্ত দয়া তাও আমি জানি। আমি আল্লাহর দয়া ও তাঁর রহমত থেকে নিরাশ নই। কেননা এই কেতাবই অন্যত্র বলছে, আল্লাহর দয়া থেকে তারাই নিরাশ হয় যারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট। (সুরা আল হেজর- ৫৬)
হযরত আহনাফ দেখলেন, এসব কিছুকে একত্রে রাখলে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে তার 'ছবি'।
কোরআনের মালিক আল্লাহ তায়ালা নিজের এ গুনাহগার বান্দাহর কথা তার কেতাবে বর্ণনা করতে ভুলেননি!
হযরত আহনাফ কোরআনের পাঠকের কথার সত্যতা অনুধাবন করে নীরবে বলে উঠলেন হে মালিক, তুমি মহান, তোমার কেতাব মহান, সত্যিই তোমার এই কিতাবে দুনিয়ার গুণী-জ্ঞানী , পাপী-তাপী, ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, সবার কথাই আছে। তোমার কেতাব সত্যিই অনুপম।
.
সুত্রঃ সাইয়্যেদ কুতুব এর তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন -প্রথম খন্ড থেকে সংগৃহীত

আরবী শিখতে হবে কেন?

কেন আরবি শিখতে হবে? আমার মাতৃভাষা বাংলা, আমি কেন আবার শুধু শুধু আরবি শিখতে যাব? আমি তো কুরআন পড়তে পারি, অনেকবার খতমও করেছি, রোজায়ও শুরু করেছি, আবার নতুন কি থিওরি নিয়ে বলতে আসলো ?? মনের ঈমানই আসল ঈমান, আরবদের তুলনায় আমাদের ইমান কোন দিক থেকে কম? ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব প্রতিবাদী কথা মনে আসাই স্বাভাবিক, এই জন্য কাউকে দোষারোপ করা যায় না একদমই। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, এই পর্যন্ত আপনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে অনেকবার কুরআন খতম করেছেন, কিন্তু আপনি এর কতটা বুঝতে পেরেছেন? ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করে মসজিদে যেয়ে হুজুরের কাছে কুরআন শিখেছেন, কিন্তু আসলে শিখেছেন শুধুই আবৃত্তি, আর কিছুই না। অনেকে আবার এই পড়াটাও পারে না। শুনতে অনেক খারাপ শুনালেও এটাই বাস্তব সত্য। এই কুরআন শিখে আপনার কি লাভ হয়েছে? কিছু মানসিক প্রশান্তি পেয়েছেন বোধ হয় আল্লাহর নৈকট্য পেয়েই গেলাম অথবা অনেক সওয়াব হাসিল হইল ইত্যাদি। আর এতেই আমরা খুশি, কিন্তু কুরআনকে তো আর আবৃত্তি করার জন্য পাঠানো হয় নাই, পাঠানো হয়েছে আমাদের গাইড লাইন হিসাবে, না বুঝে সুর করে আবৃত্তি করে আপনি গাইড লাইনের কি ই বা অনুসরন করলেন একটু বলবেন??? আমরা পুরাই ধোঁকাবাজির মধ্যে নিমজ্জিত। সমগ্র রমজান মাসে লক্ষ লক্ষ মুসলমান কুরআন খতম করবে তোতাপাখির মত খেয়ে না খেয়ে পড়ে, তাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই ভালো, কিন্তু কতই না ভালো হত যদি তারা অর্থ বুঝতে এবং অনুধাবন করতে পারত!! খতমের পর পাঠককে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, সে জানে কি না যে কি পাঠ করেছে এখন?? সন্তোষজনক জবাব পাবেন কিনা সন্দেহ!!এমন খতমে আপনি শুধু প্রতিটা হরফের জন্য বরাদ্ধ কিছু নেকি পেতে পারেন,আর কিছু না। কিন্তু এই খতম আপনার বাহ্যিক জীবনে কোন কাজেই আসলো না, আপনাকে যদি কোন অমুসলিম জিজ্ঞাসা করে , তোমার ধর্মগ্রন্থে এই বিষয়ে কোথায় কি লিখা আছে দেখাও, আপনি কি পারবেন?? না পারলে সে যদি বলে সারাদিন তাহলে কি পড়লা?? নিজে তো ডুবলেনই, ইসলামকেও ডুবিয়ে দিলেন আপনার সাথে। এই কুরআন তো শুধু তার পাঠক সংখ্যা বাড়াতে চায় নি, চেয়েছে অনুসারী, আপনি যদি বুঝারই চেষ্টা না করেন,তাহলে কিসের অনুসরণ করবেন? বুঝার চেষ্টা না করা কিন্তু অপরাধ। অপরাধ আসলে আমাদের মানসিকতায়, আমাদের নিয়মে। আমাদের ছোটবেলায় শিখান হয় সুর করে আরবি পড়া, বুঝে পড়ার কথা কারো মাথায়ই নাই। ছোটবেলা থেকে শিশুকে ইংরেজি এর পাশাপাশি আরবি ভাষা টা শিক্ষা দিলে যে তার উপকার হত, তা যদি কঠোর ধর্মমনা অভিভাবকরা বুঝত!!
নামাজে মনোযোগ দেওয়া টা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই নামাজের সময়ই দুনিয়ার সব আজে বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। একটা হাদিস শুনেছিলাম, সুত্র জানা নেই, যার বিষয়বস্তু হল, কোন মানুষ যদি তার সারা জীবনে নিশ্ছিদ্র মনোযোগের সাথে মাত্র ২ রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে কবুল করাতে পারে তাহলেই তা তাকে নিয়ে যাবে জান্নাতে। নামাজে মনোযোগ দেওয়া এতই বেশি কঠিন ।বিশুদ্ধ নামাজ এতই দুর্লভ। রোজার মাসে তারাবিহ নামাজে ১ ঘণ্টার বেশি সময় দাড়িয়ে থেকে লোকজন নামাজ পরে সত্য, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পরে কয়জন? আপনি যদি না ই বা বুঝেন হুজুর কি পড়ছে, কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখবেন? আপনি যদি আজকে আরবি ভাষাটি বুঝতেন, তাহল ইমাম কি বলছে তা অনুবাদ করে হলেও বুঝার চেষ্টা করতেন, ফলে আপনার মস্তিস্ক অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগও পেত না, ফলশ্রুতিতে আপনার মন নামাজেই থাকতো।
এটা তো হিন্দি গান না, যে আপনি অর্থ বুঝেন আর নাই বুঝেন, মুখস্ত করে সুন্দর করে গাইতে পারলেই হল! কুরআন তো আবৃত্তি করার জন্য পাঠানো হয় নি।
অনেকে বলতে পারেন, আমরা বাংলা অর্থও পড়ি, তাদের জন্য বলি, আমরা অনেক ভাল ভাল বিখ্যাত বই এর অনুবাদ পড়ি, কিন্তু আসল বই এই স্বাদ আর পাই না, মনে মনে অবাক হই, এত ফালতু বই এত এত লোক পড়ে ভাল বলল, নোবেল ও পেল, কিভাবে সম্ভব??? আসলে, অনুবাদের মান যতই ভালো হোক না কেন, আসল বইএর স্বাদ কি অনুবাদে কোনদিন পাওয়া সম্ভব? সাহাবীরা নামাজের সময় এতই মগ্ন থাকতেন, মাথায় পাখি বসলেও টের পেতেন না, এটাই প্রকৃত আল্লাহর কালিমার স্বাদ,এখন এইসব রুপকথা মনে হয়। তারা বুঝতেন, অনুধাবনও করতেন,তাই এত সিরিয়াস হতেন, আমরা বুঝি ই না,অনুধাবন করা দূরে থাক, তাই নামাজে এত অলসতা, শিথিলতা।
আমি বাংলাকে অবজ্ঞা করছি না, কিন্তু আসল কথা হল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ইংলিশে অনুবাদ করলে তা যেমন সৌন্দর্য হারাবে, এখানেও তেমন। একজন ইংরেজ তার ভাষায় অনুবাদকৃত রবি ঠাকুরের কবিতা যা বুঝবে, তার চেয়ে অনেক ভাল বুঝবে যদি সে বাংলা ভাষা শিখে তার পর বাংলায় পড়ে সেই একই কবিতা। যদিও কোথায় রবীন্দ্রনাথ, আর কোথায় কুরআন, ধৃষ্টতা মাফ করবেন, এটি শুধুই একটি রূপক উদাহরন মাত্র।
আমরা দুনিয়াতে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ কত ভাষা শিখছি, যা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। সেই তুলনায় আরবি ভাষা শিখা অনেক সহজ আমাদের জন্য, কারন আমরা এই ভাষা পড়তে পারি, লিখতে পারি, নতুন করে বর্ণমালা শিখতে হবে না আর কষ্ট করে।
আমাদের মনে হয় আরবি ভাষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আবশ্যিক হলে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের কুরআন-হাদিস পড়তে ও বুঝতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা হবে এবং সবাই যার যার ধর্ম নিজের জীবনে জেনে-বুঝে প্রতিফলিত করতে পারবে। ধর্মের অপব্যবহার কেউ করতে পারবে না। ধর্ম নিয়ে কুসংস্কার দূর হবে। নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি হবে। কুরআন পাঠ করলে সাওয়াব আছে এ কথা শুনে বসে থাকার সুযোগ নেই। কুরআন বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে।
আল্লাহ বলেন,
“তারা কি কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না। না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?
কিন্তু কিভাবে বুঝবো? যারা আরবি ভাষাভাষী নয় তাদের কুরআন বুঝার জন্য মাধ্যম হলো আরবি ভাষায় পা-িত্য অর্জন করা কিংবা অনুবাদ থেকে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মানুষের পক্ষে আরবি ভাষায় পা-িত্য অর্জনের সুযোগ নেই বিভিন্ন কারণে। সময়ের অভাব, লজ্জা আরো কতশত চিন্তা... অনেকে আবর কঠিন মনে করে শিখতে যায় না। আপনাদের সকল সমস্যার কথা মাথায় রেখেই আমাদের আরবী শেখার জন্য আমাদের এই কোর্স
সাজানো হয়েছে। মাথায় রাখা হয়েছে আপনাদের সময়ের সমস্যার কথাও। এখন শুধু প্রয়োজন আপনার আগ্রহ। যদি আগ্রহ থাকে কুরআন শিখতে চান, বুঝতে চান আর কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহন করতে আগ্রহী থাকেন। তবে দেরি না করে যোগাযোগ করুন।

আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়

আরবী ভাষা ও সাহিত্য চর্চা বিগত শতাব্দীর নববইয়ের দশক পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরবী বিভাগ এবং কওমী মাদরাসার পাঠ্যসূ...